জেট ইঞ্জিনের কার্যপ্রণালী, আকাশে গতি বাড়ানোর প্রযুক্তি।

he Working Principle of Jet Engines: Technology for Increasing Speed in the Sky.

জেট ইঞ্জিনের কার্যপ্রণালী, আকাশে গতি বাড়ানোর প্রযুক্তি।

বিমান চলাচলের ইতিহাসে জেট ইঞ্জিন এক বিপ্লব এনেছে। আধুনিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের সমন্বয়ে তৈরি এই ইঞ্জিন বিমানকে আকাশে দ্রুতগতিতে চলতে সহায়তা করে। কিন্তু কীভাবে এটি কাজ করে? এর পেছনে কী বিজ্ঞান রয়েছে? চলুন, আমরা জেট ইঞ্জিনের প্রযুক্তি, কার্যপ্রণালী এবং ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানি।

১. জেট ইঞ্জিনের মৌলিক ধারণা

জেট ইঞ্জিন এমন একটি প্রপালশন সিস্টেম যা উচ্চ গতিতে গ্যাস নির্গত করে বিমানের সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি (থ্রাস্ট) তৈরি করে। এটি মূলত নিউটনের তৃতীয় গতি সূত্র (Action = Reaction) অনুযায়ী কাজ করে। যখন ইঞ্জিনের ভেতরে গ্যাস দ্রুত বেরিয়ে আসে, তখন বিপরীত দিকে একটি শক্তি উৎপন্ন হয়, যা বিমানকে সামনের দিকে ঠেলে দেয়।

জেট ইঞ্জিনের মূল অংশ

জেট ইঞ্জিন মূলত পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ দিয়ে গঠিত: এয়ার ইনটেক – বাইরের বাতাস ইঞ্জিনে প্রবাহিত হয়। কমপ্রেসার – বাতাসকে সংকুচিত করে চাপ বাড়ায়। কম্বাশন চেম্বার – গ্যাসের সাথে জ্বালানির দহন হয় এবং শক্তি উৎপন্ন হয়। টারবাইন – গরম গ্যাস টারবাইনকে ঘুরিয়ে শক্তি উৎপাদন করে। এক্সহস্ট নোজল – উচ্চ গতিতে গ্যাস বেরিয়ে এসে থ্রাস্ট তৈরি করে।

২. জেট ইঞ্জিনের কাজ করার প্রক্রিয়া

প্রথমে বাইরের বাতাস এয়ার ইনটেক এর মাধ্যমে ইঞ্জিনে প্রবেশ করে। এই বাতাস ইঞ্জিনের ভেতরে প্রবাহিত হয়ে শক্তি উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত হয়। এরপর, এয়ার ইনটেক থেকে আসা বাতাস কমপ্রেসারে সংকুচিত হয়, যার ফলে গ্যাসের চাপ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। এতে বাতাসে উপস্থিত অক্সিজেনের ঘনত্ব বেড়ে যায়, যা দহন প্রক্রিয়াকে আরো কার্যকর করে তোলে। সংকুচিত বাতাস কম্বাশন চেম্বারে প্রবাহিত হয়, যেখানে এটি জ্বালানির (কারোসিন বা ডিজেল) সাথে মিশে জ্বলে ওঠে। এই দহনের ফলে প্রচুর তাপ ও শক্তি উৎপন্ন হয়, যা গরম গ্যাস তৈরি করে। উৎপন্ন গরম গ্যাস টারবাইনের ব্লেড ঘোরাতে শুরু করে। এই ঘূর্ণন শক্তি ইঞ্জিনের অন্যান্য অংশ যেমন কমপ্রেসার এবং ফ্যান চালানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। শেষ ধাপে, উচ্চ গতিতে গরম গ্যাস এক্সহস্ট নোজল দিয়ে বেরিয়ে আসে। এই গ্যাসের গতিবেগ বিমানের বিপরীত দিকে থ্রাস্ট তৈরি করে, যা বিমানকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

৩. জেট ইঞ্জিনের মূল বৈজ্ঞানিক নীতি

জেট ইঞ্জিন নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুসরণ করে, যেখানে বলা হয়: "প্রতিটি ক্রিয়ায় সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে।" অর্থাৎ, গ্যাস যখন পেছনের দিকে বের হয়, তখন বিমানের ওপর বিপরীত দিকে একটি ধাক্কা পড়ে, যা বিমানকে সামনের দিকে ঠেলে দেয়। জেট ইঞ্জিনে থার্মাল এক্সপানশন এবং গ্যাস কমপ্রেশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উচ্চ তাপমাত্রায় গ্যাস বিস্তার লাভ করে, যা শক্তিকে ত্বরান্বিত করে।

থ্রাস্ট ফর্মূলা


F = \dot{m} \times (V_{exit} - V_{inlet})

৪. জেট ইঞ্জিনের বিভিন্ন প্রকার

(ক) টার্বোজেট ইঞ্জিন: সাধারণত ফাইটার জেট এবং সুপারসনিক এয়ারক্রাফটে ব্যবহৃত হয়। উচ্চ গতির জন্য কার্যকর তবে জ্বালানি খরচ বেশি। (খ) টার্বোফ্যান ইঞ্জিন: বাণিজ্যিক বিমানে (যেমন, Boeing, Airbus) ব্যবহৃত হয়। কম শব্দ করে এবং বেশি জ্বালানি দক্ষ। (গ) টার্বোপ্রপ ইঞ্জিন: ছোট যাত্রীবাহী বিমান ও সামরিক ট্রান্সপোর্টে ব্যবহৃত হয়। কম গতির তবে জ্বালানির দক্ষতা বেশি। (ঘ) রকেট ইঞ্জিন: মহাকাশযানে ব্যবহৃত হয়, যেখানে অক্সিজেনের অভাব রয়েছে। এটি নিজস্ব অক্সিডাইজার ব্যবহার করে, ফলে এটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ছাড়াও কাজ করতে পারে।

৫. জেট ইঞ্জিনের সুবিধা ও ব্যবহার

উচ্চ গতি: দ্রুত আকাশে চলার উপযোগী। 

দীর্ঘ দূরত্ব: জেট ইঞ্জিনযুক্ত বিমান অনেক বেশি উচ্চতায় ও দীর্ঘ দূরত্বে চলতে পারে। 

নানা প্রয়োগ: যাত্রীবাহী বিমান, সামরিক বিমান, মহাকাশ গবেষণা এবং ড্রোনে ব্যবহৃত হয়।

৬. ভবিষ্যতে জেট ইঞ্জিনের উন্নয়ন

বিজ্ঞানীরা পরিবেশবান্ধব ও জ্বালানি দক্ষ জেট ইঞ্জিন তৈরির জন্য কাজ করছেন। কিছু সম্ভাবনাময় উদ্ভাবন: ইলেকট্রিক ও হাইব্রিড জেট ইঞ্জিন, হাইড্রোজেন-চালিত জেট ইঞ্জিন, সুপারসনিক ও হাইপারসনিক বিমান।

৭. উপসংহার

জেট ইঞ্জিন আধুনিক বিমানের প্রাণস্বরূপ। এটি নিউটনের তৃতীয় সূত্র ও থার্মোডাইনামিক্সের নিয়ম অনুসারে কাজ করে, যা বিমানকে আকাশে দ্রুত ও নিরাপদে চলার সুযোগ দেয়। ভবিষ্যতে আরো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে দক্ষ, পরিবেশবান্ধব ও শক্তিশালী জেট ইঞ্জিন তৈরি করা হবে, যা বিমান চলাচলকে আরও উন্নত ও সহজ করবে।

Post a Comment

Previous Post Next Post